গণিত কথাটির অর্থ হল গণনা সম্পর্কীয় শাস্ত্র।এটি বিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা।ভারতবর্ষে গণিত এর চর্চা সেই বৈদিক যুগ থেকে হয়ে আসছে।বৈদিক মনীষীগণ দ্বারা গণিতের পরিপূর্ণ চর্চাই ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞানকে উৎকর্ষের শিখরে উঠতে সাহায্য করেছিল বলে মনে করা হয়।বৈদিক যুগে গণিতের ভিত্তি বেদে বর্ণিত ১৬ টি সূত্র ও ১৩ টি উপসূত্রে অন্তর্নিহিত ছিল।
ভাবতে অবাক লাগে যে সময় পৃথিবীর অধিকাংশে মানবসভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন আশ্রমে ঋষিগণ বিজ্ঞানের মহাযজ্ঞে নিমগ্ন।
বৈদিকযুগে মূলতঃ দশমিক পদ্ধতিতেই গণনাকার্য সম্পন্ন হত।যজুর্বেদ সংহিতায় প্রাপ্ত বিভিন্ন সংখ্যা যেমন অর্বুদ(১০০০০০০০), নর্বুদ(১০০০০০০০০), সমুদ্র(১০০০০০০০০০), পরার্ধ(১০০০০০০০০০০০০) থেকে জানা যায় যে বিশালায়তন সংখ্যার ধারণাও হিন্দু গণিতজ্ঞদের কল্পনাতীত ছিল না।সমসাময়িক কোনও জাতি সম্ভবত এত বৃহৎ সংখ্যা কল্পনা করতে সক্ষম ছিল না।নিম্নে বর্ণিত সংখ্যাপ্রবাহ দুটিকে লক্ষ্য করুনঃ
১,৩,৫,...,৯৯
২৪,৪৮,৯৬,১৯২,.........,৩৯৩২১৬
প্রথমটির নাম সমান্তর প্রগতি এবং দ্বিতীয়টির নাম গুণোত্তর প্রগতি।‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’ ও ‘পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ’ এ যথাক্রমে উপরোক্ত প্রগতিগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়।এত গেলো পাটিগণিতের কথা।‘শতপথ ব্রাহ্মণ’ এ হিন্দুদের জ্যামিতিক জ্ঞানেরও পরিচয় পাওয়া যায়।বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে একটি অন্যতম উপকরণ ছিল ‘মহাবেদী’,যার আকৃতি হল সমদ্বিবাহু ট্রাপিজিয়াম।এই সমদ্বিবাহু ট্রাপিজিয়াম এর ক্ষেত্রফল এবং বাহু-উচ্চতার বিভিন্ন সম্পর্ক হিন্দুরা জানতেন।ঋণাত্মক রাশি সম্পর্কেও তারা অবগত ছিলেন।
উপরোক্ত ঘটনাবলীর সময়কাল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০।এরপর প্রায় ১০০০ বৎসর গণিতের মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রে হিন্দুদের বিশেষ একটা অবদান লক্ষ্য করা যায় না।
এরপর আর্যভট্ট্, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্কর প্রমুখ মনীষীবৃন্দের কর্মালোকে হিন্দু গণিতশাস্ত্র আবার বিশ্বসভায় নিজের স্থান সুদৃঢ় করে তোলে।গণিতশাস্ত্রে হিন্দু মনীষীদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য অবদান হল দশমিক স্হানিক অঙ্কপাতন পদ্ধতি ও ‘শূন্য’ এর আবিষ্কার।অবশ্য এর আগে খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ তে পিঙ্গলের ‘ছন্দসূত্রে’ শূন্যের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
আর্যভট্ট রচিত ‘আর্যভটীয়’ নামক গ্রন্থে দ্বিঘাত প্রথম মাত্রার অনির্ণেয় সমীকরণের সমাধান ও π এর নির্ভুল মান এর উল্লেখ পাওয়া যায়।বর্গমূল নির্ণয়ের পদ্ধতিও আর্যভট্টের আবিষ্কার।
এসময়ের আরেকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন ব্রহ্মগুপ্ত।তিনি পিরামিড ফ্রাস্টাম এর আয়তন নির্নয় সম্পর্কিত সুত্র আবিষ্কার করেন।
যাঁর কথা না বললে এই লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে তিনি হলেন ভাষ্কর।তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থখানি হল চারখন্ডে সমাপ্ত ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’।যার প্রথম ২টি খন্ড লীলাবতি ও বীজগণিত এ পাটীগণিত ও বীজগণিত এর বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে।“একটি ঋণাত্মক রাশিকে অপর একটি ঋণাত্মক রাশি দ্বারা গুণ করলে ধনাত্মক রাশি এবং একটি ঋণাত্মক ও অপর একটি ধনাত্মক রাশি গুণ করলে ঋণাত্মক রাশি পাওয়া যায়”, বীজগনিত এর এই সিদ্ধান্ত ভাষ্কর এর আবিষ্কার। গণিত এর ছাত্র মাত্রেই x=(-b±√(b^2-4ac))/2a সুত্রটি সম্পর্কে অবগত। এটি আবিষ্কারকের নাম শ্রীধর।দ্বিঘাত সমীকরণের মাত্রা নির্ণয়ের এই সুত্রটি ‘শ্রীধরাচার্যের উপপাদ্য’ নামে প্রচলিত।
ত্রিকোণমিতিতেও হিন্দুদের সাফল্য অনস্বীকার্য।বরাহমিহির ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ গ্রন্থে sin30 ও sin 60 এর মান নির্ণয় করে দেখিয়েছেন। বর্তমান ত্রিকোণমিতিতে ব্যবহৃত মূল সূত্রগুলিও বরাহমিহির এর আবিষ্কৃত।এছারাও সে সময়ের গণিতজ্ঞদের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্যরা হলেন মহাবীর,শ্রীপতি প্রমুখ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন